সর্বজনীন পেনশন স্কিম কী ? ধারণা,সুবিধা ও বিস্তারিত

এই নিবন্ধে আমরা সর্বজনীন পেনশন স্কিমের মূল ধারণা, এর পটভূমি এবং গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করব। এরপর স্কিমের বিভিন্ন দিক, যেমন যোগ্যতা, চাঁদা প্রদানের পদ্ধতি এবং সম্ভাব্য পেনশনের হার দেখব। শেষে আইন-কানুন এবং বিধিমালার বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরব, যাতে পাঠকরা সহজেই এই স্কিমে যোগ দিতে পারেন। এটি বয়স্ক জীবনের অর্থনৈতিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

সর্বজনীন পেনশন স্কিম কী?

বাংলাদেশের মতো দ্রুত বিকশিত দেশে জনসংখ্যার গড় আয়ু বাড়ছে, কিন্তু সেই সঙ্গে বয়স্কদের সংখ্যাও বাড়ছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার ২০২৩ সালে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছে—সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করে। এটি এমন একটি ব্যবস্থা, যা সকল নাগরিককে, বিশেষ করে ১৮ বছর বয়সীদের থেকে শুরু করে, বয়স্ক জীবনে একটি নির্ভরযোগ্য আয়ের উৎস প্রদান করে।

পটভূমি দেখলে বোঝা যায়, কর্মক্ষম জনসংখ্যা কমে যাওয়ার কারণে ভবিষ্যতে নির্বিচারে দারিদ্র্য বাড়তে পারে। এই ঝুঁকি কমাতে মহান জাতীয় সংসদ “সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন, ২০২৩” পাস করে। ৩১ জানুয়ারি ২০২৩-এ রাষ্ট্রপতির সম্মতির পর এটি গেজেটে প্রকাশিত হয়। জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের অধীনে এই স্কিম চালু হয়েছে, যা সকল শ্রেণির মানুষকে আচ্ছাদিত করার লক্ষ্য রাখে। এটি কেবল ব্যক্তিগত সঞ্চয় নয়, বরং সমগ্র সমাজের সামাজিক নিরাপত্তা জালকে মজবুত করে।

এই স্কিমের মাধ্যমে সাধারণ মানুষেরা তাদের দৈনন্দিন আয়ের একটি ছোট অংশ চাঁদা হিসেবে জমা করে, ভবিষ্যতে আজীবন মাসিক পেনশন পান। এতে কর্মজীবনের শেষ পর্যায়ে অর্থনৈতিক সংকটের ভয় কমে যায়। উদাহরণস্বরূপ, একজন যুবক যদি ২৫ বছর বয়স থেকে চাঁদা শুরু করেন, তাহলে ৬০ বছর বয়সে তিনি একটি স্থিতিশীল পেনশনের অধিকারী হন। এটি সরকারি কর্মচারীদের পেনশনের মতোই, কিন্তু সকলের জন্য উন্মুক্ত।

সর্বজনীন পেনশনের ধারণা

সর্বজনীন পেনশনের মূল ধারণা হলো “সকলের জন্য, সকলক্ষেত্রে”। এটি এমন একটি সিস্টেম যা জাতীয় পরিচয়পত্র (NID) ভিত্তিক। ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সী সকল বাংলাদেশি নাগরিক এতে যোগ দিতে পারেন, এমনকি ৫০ বছরের উপরে থাকলেও বিশেষ অনুমতিতে। ধারণাটি সহজ: নিয়মিত চাঁদা দিয়ে একটি পৃথক পেনশন অ্যাকাউন্ট তৈরি করুন, যা মুনাফাসহ বাড়বে। ১০ বছর চাঁদা শেষ হলে পেনশন শুরু হয়, এবং এটি আজীবন চলবে।

এর সাথে যুক্ত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। প্রথমত, বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশিরা বৈদেশিক মুদ্রায় চাঁদা দিতে পারেন, যা দেশে ফিরলে স্থানীয় মুদ্রায় রূপান্তরিত হয়। দ্বিতীয়ত, মৃত্যুর ক্ষেত্রে নমিনি সুবিধা পান—৭৫ বছর বয়স পর্যন্ত পেনশন বা জমা অর্থ ফেরত। তৃতীয়ত, চাঁদা আয়করমুক্ত এবং পেনশনও করমুক্ত, যা এটিকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে। এই ধারণা শুধু ব্যক্তিগত নয়, পরিবারকেন্দ্রিকও—প্রবাসীরা তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্যও অ্যাকাউন্ট খুলতে পারেন।

সর্বজনীন পেনশন স্কিমের এই ধারণা বিশ্বের অনেক উন্নত দেশের মডেল থেকে অনুপ্রাণিত, কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে খাপ খাওয়ানো হয়েছে। এটি দারিদ্র্য হ্রাস, লৈঙ্গিক সমতা এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে। উদাহরণ হিসেবে, একজন নারী যদি গৃহকর্মী হন, তাহলে এই স্কিম তাঁর বয়স্ক জীবনকে সুরক্ষিত করবে। এতে সমাজের প্রান্তিক অংশগুলোকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, যাতে কেউ বাদ না পড়ে।

সর্বজনীন পেনশন স্কিমের বিস্তারিত

সর্বজনীন পেনশন স্কিম চারটি প্রধান ক্যাটাগরিতে বিভক্ত: প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা এবং সমতা। প্রত্যেকটি আলাদা শ্রেণির জন্য ডিজাইন করা, যাতে সকলের চাহিদা পূরণ হয়।

  • প্রবাস স্কিম: বিদেশে থাকা বাংলাদেশিদের জন্য আদর্শ। তারা বৈদেশিক মুদ্রায় চাঁদা দিয়ে যোগ দিতে পারেন এবং দেশে ফিরলে স্থানীয় মুদ্রায় রূপান্তর করতে পারেন। এছাড়া, পরিবারের সদস্যদের (যেমন স্ত্রী, স্বামী, অভিভাবক) জন্যও অ্যাকাউন্ট খোলা যায়। এতে NID, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এবং নমিনির তথ্য দিয়ে সহজে নিবন্ধন সম্ভব। দেশে ফিরে সুন্দর জীবন যাপনের স্বপ্ন এই স্কিমের মাধ্যমে বাস্তবে রূপ নেয়।
  • প্রগতি স্কিম: বেসরকারি কর্মচারী এবং প্রতিষ্ঠানের জন্য। এতে নিয়মিত চাঁদা দিয়ে দ্রুত পেনশন জমা হয়।
  • সুরক্ষা স্কিম: স্বকর্মী এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মীদের জন্য, যারা নিয়মিত বেতন পান না। এটি তাদের অস্থায়ীত্বকে সুরক্ষা দেয়।
  • সমতা স্কিম: স্বল্প আয়ের ব্যক্তিদের জন্য, যাতে নিম্নবিত্তরা বাদ না পড়ে।

মাসিক চাঁদার হার ১,০০০ থেকে ১০,০০০ টাকা পর্যন্ত, এবং চাঁদার সময়কাল ১০ থেকে ৪২ বছর। নীচে একটি টেবিলে সম্ভাব্য মাসিক পেনশন দেখানো হলো (আনুমানিক হারের ভিত্তিতে):

মাসিক চাঁদা (টাকা) ৪২ বছর ৪০ বছর ৩৫ বছর ৩০ বছর ২৫ বছর ২০ বছর ১৫ বছর ১০ বছর
১,০০০ ৩৪,৪৬৫ ২৯,২০০ ১৯,১৮৭ ১২,৪৬৬ ৭,৯৫৫ ৪,৯২৭ ২,৮৯৪ ১,৫৩০
২,০০০ ৬৮,৯৩১ ৫৮,৪০০ ৩৮,৩৭৪ ২৪,৯৩২ ১৫,৯১০ ৯,৮৫৪ ৫,৭৮৯ ৩,০৬০
৫,০০০ ১,৭২,৩২৭ ১,৪৬,০০১ ৯৫,৯৩৫ ৬২,৩৩০ ৩৯,৭৭৪ ২৪,৬৩৪ ১৪,৪৭২ ৭,৬৫১
৭,৫০০ ২,৫৮,৪৯১ ২,১৯,০০১ ১,৪৩,৯০২ ৯৩,৪৯৫ ৫৯,৬৬১ ৩৬,৯৫১ ২১,৭০৮ ১১,৪৭৭
১০,০০০ ৩,৪৪,৬৫৫ ২,৯২,০০২ ১,৯১,৮৭০ ১,২৪,৬৬০ ৭৯,৫৪৮ ৪৯,২৬৮ ২৮,৯৪৪ ১৫,৩০২
এই টেবিল থেকে দেখা যায়, লম্বা সময় চাঁদা দিলে পেনশনের পরিমাণ অনেক বেশি হয়। উদাহরণস্বরূপ, ১,০০০ টাকা চাঁদা দিয়ে ৪২ বছর পর ৩৪,৪৬৫ টাকা মাসিক পাওয়া সম্ভব। এটি বিনিয়োগের মতোই, কিন্তু সুরক্ষিত এবং সরকারি গ্যারান্টি সহ। যোগদানের জন্য জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইট বা নিকটস্থ ব্যাংক অফিসে যান।

স্কিমে যোগ দেওয়ার সুবিধা অনেক। এটি ডিজিটালভাবে পরিচালিত, যাতে ট্র্যাকিং সহজ। মোবাইল অ্যাপ বা SMS-এর মাধ্যমে চাঁদা পরিশোধ সম্ভব। এছাড়া, কর্মক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলো কর্মীদের জন্য গ্রুপ অ্যাকাউন্ট খুলতে পারে। এই স্কিম বাংলাদেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করবে, কারণ বয়স্করা আরও অর্থ ব্যয় করতে পারবেন এবং সমাজে অবদান রাখতে পারবেন।

সর্বজনীন পেনশন স্কিমের সুবিধাসমূহ

সর্বজনীন পেনশন স্কিম বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য একটি নির্ভরযোগ্য আর্থিক সুরক্ষা ব্যবস্থা প্রদান করে। এর মূল সুবিধাগুলো নিম্নরূপ:

  1. সকলের জন্য উন্মুক্ত: ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী সকল বাংলাদেশি নাগরিক এই স্কিমে অংশ নিতে পারেন। বিশেষ বিবেচনায় ৫০ বছরের ঊর্ধ্ব ব্যক্তিরাও ১০ বছর নিরবচ্ছিন্ন চাঁদা প্রদান করে আজীবন পেনশন পেতে পারেন।

  2. প্রবাসীদের জন্য প্রণোদনা: প্রবাসী বাংলাদেশিরা বৈদেশিক মুদ্রায় চাঁদা দিলে ২.৫% প্রণোদনা পান, যা তাদের চাঁদায় যোগ হয়।

  3. সহজ চাঁদা প্রদান: চাঁদা জমা দেওয়া যায় ব্যাংক, মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (যেমন বিকাশ, নগদ), অনলাইন ব্যাংকিং, এবং ডেবিট/ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে। প্রবাসীরা বৈধ চ্যানেলে বৈদেশিক মুদ্রায় চাঁদা দিতে পারেন।

  4. নিরাপদ বিনিয়োগ: চাঁদার অর্থ ট্রেজারি বন্ডসহ নিরাপদ কার্যক্রমে বিনিয়োগ করা হয়, যা দীর্ঘমেয়াদী মুনাফা নিশ্চিত করে।

  5. কর সুবিধা: চাঁদা বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য হয় এবং কর রেয়াত পাওয়া যায়। মাসিক পেনশন আয়কর মুক্ত।

  6. সহজ নিবন্ধন: অনলাইনে নির্ধারিত ফরমে আবেদন করলে একটি ইউনিক আইডি দেওয়া হয়। মোবাইল নম্বর এবং প্রবাসীদের ক্ষেত্রে ইমেইলের মাধ্যমে চাঁদার তথ্য জানানো হয়।

  7. স্বয়ংক্রিয় পেনশন প্রদান: ৬০ বছর বয়সে পেনশন শুরু হয় এবং ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার (EFT) এর মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হয়। কোনো অফিসে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।

  8. নমিনী সুবিধা: পেনশনারের মৃত্যুতে নমিনী অবশিষ্ট সময় পর্যন্ত (৭৫ বছর পর্যন্ত) পেনশন পান। ১০ বছরের আগে মৃত্যু হলে জমাকৃত অর্থ মুনাফাসহ ফেরত দেওয়া হয়।

  9. নমনীয়তা: পেনশন স্কিম বা চাঁদার হার পরিবর্তন করা যায়, তবে পেনশনার আইডি অপরিবর্তিত থাকে।

  10. সোনালী ব্যাংকের সুবিধা: সোনালী ব্যাংকের প্রতিটি শাখা জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের সম্মুখ অফিস হিসেবে কাজ করে, যা নিবন্ধন ও চাঁদা জমাকে সহজ করে।

সর্বজনীন পেনশন আইন ও বিধিমালা

সর্বজনীন পেনশন স্কিমের ভিত্তি হলো আইন-কানুন। “সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন, ২০২৩” এর মাধ্যমে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ গঠিত হয়েছে। এটি সকল নিয়ম-কানুন নির্ধারণ করে। বিধিমালাগুলো নিম্নরূপ:

  • জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা: কর্তৃপক্ষের গঠন এবং কার্যাবলী।
  • পেনশন পরিচালনা পর্ষদ গঠনের প্রজ্ঞাপন: পরিচালনা বোর্ডের বিস্তারিত।
  • জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান ও সদস্যগণের চাকরির মেয়াদ ও শর্ত সম্পর্কিত বিধিমালা, ২০২৩: নেতৃত্বের শর্তাবলী।
  • সর্বজনীন পেনশন স্কিম বিধিমালা, ২০২৩: মূল স্কিমের নিয়ম।
  • সর্বজনীন পেনশন স্কিম বিধিমালার সংশোধনী (মার্চ ১৩, ২০২৪): আপডেটেড পরিবর্তন।
  • আয়কর রেয়াত এবং করমুক্ত পেনশন সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন: কর সুবিধা।
  • সর্বজনীন পেনশন স্কিম বিধিমালার সংশোধনী (আগস্ট ৭, ২০২৪): সাম্প্রতিক সংশোধনী।
  • জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের ২০২৩-২৪ বাজেট: আর্থিক পরিকল্পনা।
  • সর্বজনীন পেনশন স্কিম তহবিল (বিনিয়োগ ও সংরক্ষণ) বিধিমালা, ২০২৪: তহবিল ব্যবস্থাপনা।
  • প্রত্যয় স্কিম বাতিলের প্রজ্ঞাপন: পুরনো স্কিমের বিলুপ্তি।

এছাড়া, অনানুষ্ঠানিক ইংরেজি অনুবাদও উপলব্ধ। এই ডকুমেন্টগুলো জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইট থেকে ডাউনলোড করা যায়। আইনটি নিশ্চিত করে যে স্কিমটি স্বচ্ছ এবং দুর্নীতিমুক্ত। যেকোনো পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সরকারি গেজেট অনুসরণ করুন।

শেষ কথা

সর্বজনীন পেনশন স্কিম বাংলাদেশের জন্য একটি মাইলফলক। এটি কেবল অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নয়, বরং সমাজের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করে। আজই যোগ দিন, কালকের জন্য প্রস্তুত হোন। যদি আরও তথ্য চান, কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। এই স্কিম আমাদের সকলের ভবিষ্যতকে উজ্জ্বল করবে—একসঙ্গে এগিয়ে চলুন।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *